ক্রিকেটে DRS কীভাবে কাজ করে 2025

ক্রিকেটে DRS কীভাবে কাজ করে 2025

Spread the love

ক্রিকেট খেলাটা আমাদের রক্তে মিশে আছে, তাই না? ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—সবকিছুতেই যেন এক অন্যরকম উত্তেজনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে মনে প্রশ্ন জাগে। আউট ছিল কি ছিল না? রানআউটটা ঠিক ছিল তো? এই ধোঁয়াশা দূর করতেই ক্রিকেটে এসেছে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি—ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম বা ডিআরএস (DRS)। ভাবছেন, এই ডিআরএস জিনিসটা আসলে কী আর এই ক্রিকেটে DRS কীভাবে কাজ করে চলুন, আজ আমরা এই রহস্যের জট খুলি।

ক্রিকেটে DRS কী এবং কেন?

ডিআরএস হলো এমন একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা, যা আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেয়। ক্রিকেট মাঠে আম্পায়াররা সাধারণত যা দেখেন, তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু খেলার গতি আর প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে দেখা গেছে, কিছু সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়ে ওঠে। খেলোয়াড় বা দলের মনে হতে পারে, আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এই ভুল সংশোধনের জন্যই ডিআরএস চালু করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, খেলার স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যাতে কোনো দল বা খেলোয়াড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করা।

ডিআরএস-এর জন্মকথা

ডিআরএস প্রথম ব্যবহার করা হয় ২০০৮ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এটি ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। শুরুতে এর ব্যবহার নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও, বর্তমানে এটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রায় সব ফরম্যাটেই প্রচলিত। এর ফলে খেলার মান যেমন বেড়েছে, তেমনি আম্পায়ারদের ওপর চাপও কমেছে।

ক্রিকেটে DRS কীভাবে কাজ করে?

ডিআরএস কীভাবে কাজ করে?

ডিআরএস কোনো একক প্রযুক্তি নয়; এটি কয়েকটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি সিস্টেম। প্রতিটি প্রযুক্তি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে, কিন্তু সম্মিলিতভাবে তারা আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় সাহায্য করে। চলুন, দেখে নিই এই প্রযুক্তির মূল উপাদানগুলো কী কী:

১. হট স্পট (Hot Spot)

হট স্পট হলো একটি ইনফ্রারেড ইমেজিং সিস্টেম। এটি ব্যাটে বা প্যাডে বল লাগলে তার তাপমাত্রার পরিবর্তন রেকর্ড করে। যখন বল ব্যাটে বা প্যাডে স্পর্শ করে, তখন সেই জায়গায় ঘর্ষণের কারণে তাপ উৎপন্ন হয়। হট স্পট ক্যামেরা সেই তাপমাত্রার পরিবর্তনকে একটি উজ্জ্বল আলোর শিখার মতো দেখায়। এর ফলে বোঝা যায়, বল কোথায় লেগেছে। যেমন, এলবিডব্লিউ (LBW) বা ক্যাচের ক্ষেত্রে বল ব্যাটে লেগেছে কিনা, তা জানতে হট স্পট খুব কার্যকর।

২. স্নিকোমিটার (Snickometer)

স্নিকোমিটার একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি। এটি স্টাম্পে বসানো অত্যন্ত সংবেদনশীল মাইক্রোফোন ব্যবহার করে। যখন বল ব্যাট, প্যাড বা উইকেটে স্পর্শ করে, তখন এটি একটি নির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে। স্নিকোমিটার সেই শব্দ তরঙ্গকে গ্রাফিক্যাল ফর্মে দেখায়। যদি বল ব্যাটে লাগে, তাহলে হট স্পটের সাথে স্নিকোমিটারেও একটি পিক দেখা যায়। এটিও ক্যাচ বা এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্তে সাহায্য করে।

৩. বল ট্র্যাকিং (Ball Tracking) বা হক-আই (Hawk-Eye)

হক-আই হলো ডিআরএস-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি সম্পূর্ণ কম্পিউটার-ভিত্তিক একটি সিস্টেম, যা বলের গতিপথ ট্র্যাক করে। একাধিক হাই-স্পিড ক্যামেরা ব্যবহার করে বলের গতি, বাউন্স এবং উইকেটের দিকে তার প্রক্ষেপণ পরিমাপ করা হয়। এলবিডব্লিউর ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য। যখন একজন ব্যাটসম্যান এলবিডব্লিউর জন্য রিভিউ করেন, তখন হক-আই দেখায় যে বল যদি প্যাডে না লাগত, তাহলে তা স্টাম্পে আঘাত করত কিনা। এটি খুবই নির্ভুলভাবে বলের সম্ভাব্য গতিপথ দেখাতে পারে।

৪. আল্ট্রাএজ (UltraEdge)

আল্ট্রাএজ স্নিকোমিটারের মতোই একটি অডিও-ভিত্তিক প্রযুক্তি, যা আরও উন্নত এবং নির্ভুল। এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ সনাক্ত করতে পারে। যখন বল ব্যাট, প্যাড বা উইকেটে স্পর্শ করে, তখন আল্ট্রাএজ সেই শব্দকে গ্রাফিক্যাল ফর্মে উপস্থাপন করে। স্নিকোমিটারের চেয়ে এটি অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং ছোট ছোট স্পর্শও ধরতে পারে, যা আম্পায়ারদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ করে তোলে।

৫. স্টাম্প মাইক্রোফোন (Stump Microphone)

স্টাম্প মাইক্রোফোনগুলো মাঠের বিভিন্ন শব্দ রেকর্ড করে, যা টিভি ব্রডকাস্টের জন্য ব্যবহৃত হয়। ডিআরএস প্রক্রিয়ায় এটি আল্ট্রাএজ এবং স্নিকোমিটারের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে, যাতে বলের স্পর্শের শব্দ আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

ডিআরএস কীভাবে কাজ করে?

ক্রিকেটে DRS ব্যবহারের নিয়মকানুন

ডিআরএস ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, যা প্রতিটি দল বা খেলোয়াড়কে মেনে চলতে হয়:

  • রিভিউয়ের সংখ্যা: প্রতিটি দল প্রতিটি ইনিংসে নির্দিষ্ট সংখ্যক রিভিউ নিতে পারে (সাধারণত টেস্টে ৩টি, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ১ বা ২টি)। যদি রিভিউ সফল হয়, অর্থাৎ আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পাল্টায়, তাহলে রিভিউটি হারানো যায় না। কিন্তু যদি রিভিউ ব্যর্থ হয়, তাহলে দলটি একটি রিভিউ হারায়।
  • রিভিউয়ের সময়সীমা: আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের পর সাধারণত ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে রিভিউয়ের আবেদন করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে ব্যাটসম্যান বা ফিল্ডিং দলের অধিনায়ককে ‘টি’ সাইন (T-sign) দেখিয়ে রিভিউয়ের ইঙ্গিত দিতে হয়।
  • আম্পায়ারের ভূমিকা: মাঠের আম্পায়ার প্রথমে সিদ্ধান্ত দেন। এরপর রিভিউ চাওয়া হলে থার্ড আম্পায়ার (টিভি আম্পায়ার) বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করেন।
  • আম্পায়ার্স কল (Umpire’s Call): এটি ডিআরএস-এর একটি বিশেষ নিয়ম। যখন বল ট্র্যাকিং সিস্টেমে (হক-আই) দেখা যায় যে, বল স্টাম্পে অল্পের জন্য লাগতো বা লাগতো না, অর্থাৎ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত ক্লোজ হয় এবং মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত একেবারে ভুল না হয়, তখন থার্ড আম্পায়ার মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। এক্ষেত্রে রিভিউটি হারানো যায় না।
ক্রিকেটে DRS

ডিআরএস এর সুবিধা ও অসুবিধা

ডিআরএস ক্রিকেটে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

সুবিধা:

  • ভুল সিদ্ধান্ত হ্রাস: ডিআরএস-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি ভুল সিদ্ধান্তের হার অনেক কমিয়ে দেয়। এতে খেলার ফলাফল আরও ন্যায্য হয়।
  • খেলোয়াড়দের আস্থা বৃদ্ধি: খেলোয়াড়রা জানেন যে, যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে তা সংশোধনের সুযোগ আছে। এতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
  • খেলার স্বচ্ছতা: ডিআরএস খেলার স্বচ্ছতা বাড়ায়। দর্শকরাও বুঝতে পারেন, কেন একটি সিদ্ধান্ত দেওয়া হলো।
  • আম্পায়ারদের চাপ কমানো: ডিআরএস আম্পায়ারদের ওপর থেকে অনেক চাপ কমায়, কারণ তাদের ভুল সিদ্ধান্ত সংশোধনের সুযোগ থাকে।

অসুবিধা:

  • সময়সাপেক্ষ: প্রতিটি রিভিউ প্রক্রিয়াজাত করতে কিছুটা সময় লাগে, যা খেলার গতি কমিয়ে দেয়।
  • প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা: যদিও প্রযুক্তি অনেক উন্নত, তবুও এটি ১০০% নির্ভুল নয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা বা মানব ত্রুটির কারণে ভুল হতে পারে।
  • বিতর্ক: কিছু ক্ষেত্রে আম্পায়ার্স কল বা প্রযুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে এখনও বিতর্ক দেখা যায়।
  • খরচ: ডিআরএস সিস্টেম স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল, যা সব ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে ডিআরএস

বাংলাদেশের ক্রিকেটে ডিআরএস এখন একটি পরিচিত নাম। বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচে এটি নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। শুরুতে ডিআরএস নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও, এখন এর ব্যবহার অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। আমাদের খেলোয়াড় এবং দর্শকরাও এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অনেক সময় দেখা যায়, একটি ডিআরএস সিদ্ধান্ত ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন ডিআরএস-এর প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করেন।

আপনি যদি ক্রিকেট নিয়ে আরও জানতে আগ্রহী হন, তাহলে ক্রিকেটে স্ট্রাইক রেট এবং ইকোনমি রেট সম্পর্কে এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। এছাড়া, খেলার পরিসংখ্যান সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিফেন্সিভ ও অফেন্সিভ পরিসংখ্যান সম্পর্কিত কন্টেন্টটিও আপনার কাজে আসতে পারে।

ভবিষ্যৎ ডিআরএস

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ডিআরএস-ও আরও উন্নত হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমরা আরও নির্ভুল এবং দ্রুত ডিআরএস দেখতে পাব বলে আশা করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার ডিআরএসকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। হয়তো একদিন এমন সিস্টেম আসবে, যেখানে সেকেন্ডের মধ্যে নির্ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হবে।

ক্রিকেট শুধু একটি খেলা নয়, এটি আমাদের আবেগ। আর এই আবেগ আরও সুন্দর হয়ে ওঠে যখন খেলাটা স্বচ্ছ এবং ন্যায্য হয়। ডিআরএস সেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর মাধ্যমে ক্রিকেট আরও বেশি উপভোগ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।

এখন নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন, ক্রিকেটে ডিআরএস কীভাবে কাজ করে এবং এর গুরুত্ব কতটা? আপনার কি মনে হয়, ডিআরএস ক্রিকেটের জন্য আশীর্বাদ না কি অভিশাপ? আপনার মতামত আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *